Sunday, January 25, 2015

Lalon লালন


লালন
সাঁই, শাহ (ফার্সি ভাষায় سای)
Fakir Lalon Shah.jpg
লালনের জীবদ্দশায় তৈরি করা একমাত্র চিত্র, ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্ম ১৭৭৪
অবিভক্ত বাংলা (বর্তমান  বাংলাদেশ )[১]
মৃত্যু ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ (১১৬ বছর)
ছেউড়িয়া, কুষ্টিয়া, অবিভক্ত বাংলা (বর্তমান  বাংলাদেশ)
মৃত্যুর কারণ বার্ধক্য
সমাধি ছেউড়িয়া, কুষ্টিয়া
২৩°৫৩′৪৪″ উত্তর ৮৯°০৯′০৭″ পূর্ব
বংশোদ্ভূত বাঙালী
পেশা সাধক, গায়ক, গীতিকার, সুরকার
যে জন্য পরিচিত বাউল গান, মানবতাবাদী দর্শন
ধরণ বাউল গান
প্রভাবিত হয়েছেন সিরাজ সাঁই
প্রভাবিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর[২][৩], কাজী নজরুল ইসলাম[৪]গগন হরকরা, অ্যালেন গিন্সবার্গ[৫]
উপাধি ফকির, মহাত্মা, বাউল সম্রাট
ধর্ম অজ্ঞাত
দম্পতি বিশখা

লালন (জন্ম ১৭৭৪- মৃত্যু অক্টোবর ১৭, ১৮৯০) বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালী যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও
পরিচিত।[৬] তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৭][৮] তার গানের মাধ্যমেই ঊনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।[৯] লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী যিনি ধর্ম, বর্ন, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গানসমূহ রচনা করেন।[১০] তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুলের মত বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবিসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কন্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে।[১০] গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।[১১]

জীবনী

নন্দলাল বসুর আঁকা লালনের এই কাল্পনিক চিত্রই সাধারন মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।

কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।
— লালন, আত্মতত্ত্ব
লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। তার সবচেয়ে অবিকৃত তথ্যসুত্র তার নিজের রচিত অসংখ্য গান। কিন্তু লালনের কোন গানে তার জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য তিনি রেখে যাননি, তবে কয়েকটি গানে তিনি নিজেকে "লালন ফকির" হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশতঃ কিছুই বলিতে পারে না।"[১২] লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। লালন নিজে কখনো তা প্রকাশ করেননি। কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হারিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন।[১] কোন কোন লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন। এই মতের সাথেও অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন। বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে বলে উল্লেখ করা হয়।[১৩]
হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে , লালন তরুন বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথীরা তাকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান তাকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তার কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। গুটিবসন্ত রোগে একটি চোখ হারান লালন।[১৪] ছেঊরিয়াতে তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হন।[১৫] এছাড়া লালন সংসারী ছিলেন বলে জানা যায়। তার সামান্য কিছু জমি ও ঘরবাড়ি ছিল।[১২] লালন অশ্বারোহনে দক্ষ ছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে অশ্বারোহনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে যেতেন।[১২]

ধর্ম বিশ্বাস


জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সব দেখি তা না না না।
- - - - - - - - - - -
- - - - - -
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রমও তো গেল না।
— লালন, ধর্মতত্ত্ব
লালনের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে যথেষ্ঠ মতভেদ রয়েছে, যা তার জীবদ্দশায়ও বিদ্যমান ছিল।[১৬] তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকার মহাত্মা লালন নিবন্ধে প্রথম লালন জীবনী রচয়িতা বসন্ত কুমার পাল বলেছেন- "সাঁইজি হিন্দু কি মুসলমান, এ কথা আমিও স্থির বলিতে অক্ষম।"[১৭][১৮] বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোন ধরনের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতেও দেখা যায় নি। লালনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দুধর্ম এবং ইসলামধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায়।[১৫] প্রবাসী পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়, লালনের সকল ধর্মের লোকের সাথেই সুসম্পর্ক ছিল। মুসলমানদের সাথে তার সুসম্পর্কের কারনে অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করত। আবার বৈষ্ণবধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাকে বৈষ্ণব মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।[১৯]
বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়।[১৩] আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়।[২০]
লালনের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন,
‘‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনোও বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’’[২১]
লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,
‘‘কাঙাল হরিনাথ তাঁকে জানতেন, মীর মশাররফ চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক জলধর সেন বা অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁকে সামনাসামনি দেখেছেন কতবার, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেননি লালনের জাতপরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।”[১৭]
একটি গানে লালনের প্রশ্নঃ
‘‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।[২২]
কিছু লালন অনুসারী যেমন মন্টু শাহের মতে, তিনি হিন্দু বা মুসলমান কোনটিই ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন ওহেদানিয়াত নামক একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী।[২৩] ওহেদানিয়াতের মাঝে বৌদ্ধধর্ম এবং বৈষ্ণব ধর্মের সহজিয়া মতবাদ, সুফিবাদ সহ আরও অনেক ধর্মীয় মতবাদ বিদ্যমান। লালনের অনেক অনুসারী লালনের গানসমূহকে এই আধ্যান্তিক মতবাদের কালাম বলে অভিহিত করে থাকে।[২৩]
লালনের আখড়া, যেখানে বর্তমানে তার মাজার অবস্থিত

লালনের আখড়া

লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। তার শিষ্যরা তাকে “সাঞ’’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি প্রতি শীতকালে আখড়ায় একটি ভান্ডারা (মহোৎসব) আয়োজন করতেন। যেখানে সহস্রাধিক শিষ্য ও সম্প্রদায়ের লোক একত্রিত হতেন এবং সেখানে সংগীত ও আলোচনা হত। চট্টগ্রাম, রঙপুর, যশোর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্য্যন্ত বাংলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক লালন ফকীরের শিষ্য ছিলেন; শোনা যায় তার শিষ্যের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের বেশি ছিল।[১২]

ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্পর্ক

লালনের সমাধি
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল বলে বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া যায়। বিরাহিমপুর পরগনায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিতে ছিল তাঁর বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। ঊনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে তার প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে ঠাকুর পরিবার বড় ভূমিকা রাখেন।
কিন্তু এই ঠাকুরদের সঙ্গে লালনের একবার সংঘর্ষ ঘটে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়ার কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এরই একটি সংখ্যায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা বিষয়টির তদন্তে প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন। এতে করে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ওপর বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে শিষ্যদের নিয়ে লালন সশস্ত্রভাবে জমিদারের লাঠিয়ালদের মোকাবিলা করেন এবং লাঠিয়াল বাহিনী পালিয়ে যায়। এর পর থেকে কাঙাল হরিনাথকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করেছেন লালন।[২৪]
লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরী করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যদিও অনেকের দাবী এই স্কেচটিতে লালনের আসল চেহারা ফুটে ওঠেনি।[৭][২৫]

মৃত্যু

১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেতে তিনি পেটের সমস্যা ও হাত পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতেন না। এসময় তিনি মাছ খেতে চাইতেন। মৃত্যুরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেনঃ “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তার মৃত্যু হয়। তার নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তার মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয় নি। তারই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তার আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তার সমাধি করা হয়।[১২] আজও সারা দেশ থেকে বাউলেরা অক্টোবর মাসে ছেউড়িয়ায় মিলিত হয়ে লালনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত হিতকরীতে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম রাইচরণ।[১২]

দর্শন

আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।।
— লালন , দেহতত্ত্ব
লালনের গানে মানুষ ও তার সমাজই ছিল মুখ্য। লালন বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ। তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে মানবতাবাদকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন।[২৬] তার বহু গানে এই মনের মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন মনের মানুষের কোন ধর্ম, জাত, বর্ন, লিঙ্গ, কূল নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সকল মানুষের মনে ঈশ্বর বাস করেন।[১৭][২৭] লালনের এই দর্শনকে কোন ধর্মীয় আদর্শের অন্তর্গত করা যায় না।[২৮] লালন, মানব আত্নাকে বিবেচনা করেছেন রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্ত্বা রূপে। খাচার ভিতর অচিন পাখি গানে তিনি মনের অভ্যন্তরের সত্ত্বাকে তুলনা করেছেন এমন এক পাখির সাথে, যা সহজেই খাঁচা রূপী দেহের মাঝে আসা যাওয়া করে কিন্তু তবুও একে বন্দি করে রাখা যায় না। [২৯][৩০]
লালনের সময়কালে যাবতীয় নিপীড়ন, মানুষের প্রতিবাদহীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা সেদিনের সমাজ ও সমাজ বিকাশের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।[১৭] সমাজের নানান কুসংস্কারকে তিনি তার গানের মাধ্যমে করেছেন প্রশ্নবিদ্ধ। [৫][৩১] আর সে কারণেই লালনের সেই সংগ্রামে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু শিষ্ট ভূস্বামী, ঐতিহাসিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবী, লেখক এমনকি গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষও। আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছিলেন। তার সহজ-সরল শব্দময় এই গানে মানবজীবনের রহস্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে।[১৫] লালনের বেশ কিছু রচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে অতীব সংবেদনশীল ছিলেন। ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেদ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।[৫][১৭][৩২] তিনি মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। মানবতাবাদী লালন দর্শনের মূল কথা হচ্ছে মানুষ। আর এই দর্শন প্রচারের জন্য তিনি শিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন। লালনকে অনেকে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রদায়িক পরিচয় দিয়ে। কেউ তাকে হিন্দু, কেউ মুসলমান হিসেবে পরিচয় করাবার চেষ্টা করেছেন। লালনের প্রতিটি গানে তিনি নিজেকে ফকির ( আরবি "সাধু") হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
লালন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনঃ
লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন - আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।[৩৩]
যদিও তিনি একবার লালন 'ফকির' বলেছেন, এরপরই তাকে আবার 'বাউল' বলেছেন, যেখানে বাউল এবং ফকিরের অর্থ পারস্পরিক সংঘর্ষপ্রবণ।

বাউল দর্শন

বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। লালনকে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৭][৮] বাউল মত সতেরো শতকে জন্ম নিলেও লালনের গানের জন্য ঊনিশ শতকে বাউল গান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাউল গান যেমন মানুষের জীবন দর্শন সম্পৃক্ত বিশেষ সুর সমৃদ্ধ। বাউলরা সাদামাটা জীবনযাপন করেন[১৫][৩৪] এবং একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোই তাদের অভ্যাস।[৩৫] বাংলা লোকসাহিত্যের একটি বিশেষ অংশ। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বাউল গানকে বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করে।[৩৬]
বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক।[১৫] তারা মানবতার বাণী প্রচার করেন। বাউল মতবাদের মাঝে বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।[৩৭] বাউলরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে।[৩৮] তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়।[৩৯] আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করেন। সাধারণত অশিক্ষিত হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন।[৪০] বাউলরা তাদের দর্শন ও মতামত বাউল গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন।[৭]

বিশ্ব সাহিত্যে প্রভাব

লালনের শিষ্য ভোলাই শাহের হাতে লেখা লালনের নাম। উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে অপ্রচলিত বাংলা অক্ষরে লেখা।
লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লালনের মৃত্যুর ২ বছর পর তার আখড়া বাড়িতে যান এবং লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন।[৪১] তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও রচনায় তিনি লালনের প্রসংগ তুলে ধরেছেন।[৪২] লালনের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলীতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরন দেখা যায়। তিনি After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন।[৫] লালনের সংগীত ও ধর্ম-দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। ১৯৬৩ ছেঁউড়িয়ায় আখড়া বাড়ি ঘিরে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ১৯৭৮ সালে শিল্পকলা একাডেমীর অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় লালন একাডেমী। তার মৃত্যু দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় স্মরণ উৎসব হয়। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ লালন স্মরণোৎসব ও দোল পূর্ণিমায় এই আধ্যাত্মিক সাধকের দর্শন অনুস্মরণ করতে প্রতি বছর এখানে এসে থাকেন। ২০১০ সাল থেকে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসব হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানটি "লালন উৎসব" হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালে এখানে ১২২তম লালন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।[৪৩]

জনপ্রিয় মাধ্যমে লালন

লালনের আখড়ায় লালন গানের চর্চারত কয়েকজন ভক্ত

উপন্যাস

রণজিৎ কুমার লালন সম্পর্কে সেনবাউল রাজা নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরেশ ভট্টাচার্য রচনা করেন বাউল রাজার প্রেম নামে একটি উপন্যাস। ভারতের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লালনের জীবনী নিয়ে রচনা করেন মনের মানুষ উপন্যাস। এই উপন্যাসে কোন নির্ভরযূগ্য সূত্র ব্যতরেকেই লালনকে হিন্দু কায়স্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হরা হয়েছ, নাম দেয়া হয়েছে লালন চন্দ্র কর।[১০]রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গোরা’ শুরু হয়েছে লালনের গান ‘‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’’ দিয়ে।[৭]

ছোট গল্প

১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে সুনির্মল বসু লালন ফকিরের ভিটে নামে একটি ছোট গল্প রচনা করেন। শওকত ওসমান ১৯৬৪ খ্রীস্টাব্দে রচনা করেন দুই মুসাফির নামের একটি ছোটগল্প।[২২]

চলচ্চিত্র

মনের মানুষ চলচ্চিত্রে লালন চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
লালনকে নিয়ে কয়েকটি চলচিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালনা করেন লালন ফকির চলচিত্রটি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে একই নামে একটি চলচিত্র নির্মাণ করেন। ম. হামিদ ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্র দ্যাখে কয়জনা যা বাংলাদেশে টেলিভিশনে প্রদর্শিত হয়। তানভীর মোকাম্মেল ১৯৯৬ সালে পরিচালনা করেন তথ্যচিত্রঃ অচিন পাখি[২২] ২০০৪ সালে তানভির মোকাম্মেলের পরিচালনায় লালন নামে একটি চলচিত্র নির্মাণ করা হয়। এছাড়া ২০১০ এ সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে গৌতম ঘোষ মনের মানুষ নামে একটি চলচিত্র নির্মাণ করে যা ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ৪১তম ভারত ফিল্ম- ফ্যস্টিভ্যালে সেরা চলচ্চিত্রর পুরষ্কার লাভ করে। উল্লেখ্য যে এই চলচ্চিত্রে লালনকে কোন উল্যেখযোগ্য সূত্র ছাড়াই হিন্দু হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি অনেক সমালোচনার মুখোমুখী হয়।[১০][৪৪][৪৫][৪৬][৪৭]

কবিতা

আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তার রচনাবলীতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরন দেখা যায়। তিনি After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন।[৫] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন তিনি লালনের আছে যার মনের মানুষ সে মনে এই গানে উল্লেখিত মনের মানুষ কে তা আবিস্কার করতে পেরেছেন। [৪৮][৪৯] এ প্রসঙ্গে তিনি একটি কবিতাও রচনা করেন। যার কথা ছিল আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রানে, তাই হেরি তায় সকলখানে...[৫]

লালনের গান

লালনের গান লালগীতি বা লালন সংগীত হিসেবে পরিচিত।[৫০] লালন তার সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তার রচিত গানে তিনি একই সাথে প্রশ্ন ও উত্তর করার একটি বিশেষ শৈলি অনুসরন করেছেন। এছাড়া তার অনেক গানে তিনি রুপকের আড়ালেও তার নানান দর্শন উপস্থাপন করেছেন।

গানের জনপ্রিয়তা

সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে লালনের গান বেশ জনপ্রিয়। স্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় গানটির অবস্থান ১৪তম।[৫১] আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষ-পরমতত্ত্ব, আল্লা-নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ-গৌরতত্ত্ব এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে লালনের গান রয়েছে। লালনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গানঃ
  • আমি অপার হয়ে বসে আছি
  • সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
  • জাত গেলো জাত গেলো বলে
  • খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়
  • আপন ঘরের খবর লে না
  • আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী
  • মন তুই করলি একি ইতরপনা
  • এই মানুষে সেই মানুষ আছে
  • যেখানে সাঁইর বারামখানা
  • বাড়ির কাছে আরশিনগর
  • আমার আপন খবর আপনার হয় না
  • দেখ না মন, ঝকমারি এই দুনিয়াদারী
  • ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফান্দ পেতে
  • সব সৃষ্টি করলো যে জন
  • সময় গেলে সাধন হবে না
  • আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
  • তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
  • এসব দেখি কানার হাট বাজার
  • মিলন হবে কত দিনে
  • কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা

ফরিদা পারভিন উপমহাদেশের সেরা লালন সঙ্গীত শিল্পিদের একজন। আনুশেহ আনাদিল, অরূপ রাহী, লালন ব্যান্ডের সূমী, ক্লোজ-আপ তারকা রিংকু দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় লালন সঙ্গীত শিল্পি। লালনের মাজারে অসংখ্য বাউল শিল্পি একতারা বাজিয়ে লালন গানের চর্চা করে থাকেন।

গানের সংগ্রহ

লালনের গান "লালনগীতি" বা কখনও "লালন সংগীত" হিসেবে প্রসিদ্ধ। লালন মুখে মুখে গান রচনা করতেন এবং সুর করে পরিবেশন করতেন। এ ভাবেই তার বিশাল গান রচনার ভান্ডার গড়ে উঠে। তিনি সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন বলে ধারনা করা হয়।[৫২] তবে তিনি নিজে তা লিপি বদ্ধ করেন নি। তার শিষ্যরা গান মনে রাখতো আর পরবর্তিতে লিপিকার তা লিপিবদ্ধ করতেন। আর এতে করে তার অনেক গানই লিপিবদ্ধ করা হয়নি বলে ধারনা করা হয়।[৫৩]
বাউলদের জন্য তিনি যেসব গান রচনা করেন, তা কালে-কালে এত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে মানুষ এর মুখে মুখে তা পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের গানে প্রভাবিত হয়ে, প্রবাসী পত্রিকার ‘হারামনি’ বিভাগে লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করেন।[৭] মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন একাই তিন শতাধিক লালন গীতি সংগ্রহ করেছেন যা তাঁর হারামণি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর অন্য দুটি গ্রন্থের শিরোনাম যথাক্রমে ‘লালন ফকিরের গান’ এবং ‘লালন গীতিকা’ যাতে বহু লালন গীতি সংকলিত হয়েছে। জ্যোতিরিন্দ্রিনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘বীণা’, ‘বাদিনী’ পত্রিকায় ৭ম সংখ্যা ২ ভাগ (মাঘ) ১৩০৫-এ ‘পারমার্থিক গান’ শিরোনামে লালনের ‘ক্ষম অপরাধ ও দীননাথ’ গানটি স্বরলিপিসহ প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকায় ৮ম সংখ্যা ২ ভাগ (ফাগুন) ১৩০৫-এ প্রকাশিত আরেকটি লালনগীতি ‘কথা কয় কাছে দেখা যায় না’ দুটি গানেরই স্বরলিপি করেন ইন্দিরা দেবী। প্রেমদাস বৈরাগী গীত এ লালন গীতি সংগ্রহ করেছিলেন মুহাম্মাদ মনসুরউদ্দীন এবং তা মাসিক প্রবাসী পত্রিকার হারামণি অংশে প্রকাশিত হয়েছিল।
লালনের গানের কথা, সুর ও দর্শনকে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, অনেক গান যাতে লালন বলে কথাটির উল্লেখ আছে তার সবই প্রকৃতপক্ষে লালনের নয়।[১] মন্টু শাহ নামের একজন বাউল, তিন খন্ডের একটি বই প্রকাশ করেছেন যাতে তিনি মনিরুদ্দিন শাহ নামক লালনের সরাসরি শিষ্যের সংগৃহীত লালন সংগীতগুলো প্রকাশ করেছেন।[১]

বিতর্ক ও সমালোচনা

সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদীরা লালনের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারনে তার সর্বাধিক সমালোচনা করে থাকে। লালন তার জীবদ্দশায় নিজের ধর্ম পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ করেননি। তার ধর্ম বিশ্বাস আজও একটি বিতর্কিত বিষয়।[৫৪] লালনের অসাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা ইত্যাদির কারনে তাকে তার জীবদ্দশায় ধর্মান্ধ এবং মৌলবাদী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘৃণা, বঞ্চনার এবং আক্রমনের শিকার হতে হয়।[৫][৫৫] এছাড়া তার ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী দর্শন এবং ঈশ্বর, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে তার উত্থাপিত নানান প্রশ্নের[২২] কারনে অনেক ধর্মবাদী তাকে নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।[৫৬]

No comments:

Post a Comment