রজনীকান্ত সেন
রজনীকান্ত সেন | |
---|---|
জীবিকা | কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
জাতি | বাঙালি |
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারতীয় |
সময়কাল | বাংলার নবজাগরণ |
ধরণ | গান, কবিতা |
সাহিত্য আন্দোলন | বাংলার নবজাগরণ |
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ | কান্তগীতি, বাণী, কল্যাণী, অমৃতা |
দম্পতি | হিরন্ময়ী দেবী |
রজনীকান্ত সেন (জন্মঃ ২৬ জুলাই, ১৮৬৫ - মৃত্যুঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০) প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয়
হয়ে আছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। ঈশ্বরের আরাধনায় ভক্তিমূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়।
শৈশবকাল
পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত। গুরুপ্রসাদ চারশত বৈষ্ণব ব্রজবুলী কবিতাসঙ্কলনকে একত্রিত করে 'পদচিন্তামণিমালা' নামক কীর্তন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও 'অভয়াবিহার' গীতি-কাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। মনোমোহিনী দেবী সু-গৃহিণী ছিলেন। রজনীকান্তের জন্মের সময় তিনি কটোয়ায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর শৈশবকালীন সময়ে তিনি অনেক জায়গায় চাকুরী করেন। ১৮৭৫ সালে বরিশালের সাব-জজ পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। ফলে তাঁদের পুরো পরিবার জ্যেঠার বড় ছেলে - বরদা গোবিন্দ এবং কালী কুমারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। দূর্ভাগ্যবশতঃ ১৮৭৮ সালে তারা উভয়েই আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। রজনী'র ছোট ভাই জানকীকান্ত জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়েও মারা যায়। ফলে, আকস্মিকভাবেই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারটি চরম আর্থিক সঙ্কটে নিপতিত হয়। বড় ভাই গোবিন্দনাথও একজন সফল আইনজীবী ছিলেন।শিক্ষাজীবন
শৈশবে রজনী খুবই দুষ্টপ্রকৃতির অধিকারী ও সদা-সর্বদাই খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁর নৈতিক চরিত্র সকলের আদর্শস্থানীয় ছিল। তিনি পড়াশোনায় কিঞ্চিৎ সময় ব্যয় করার সুযোগ পেতেন। তারপরও পরীক্ষায় আশাতীত ফলাফল অর্জন করতে পারতেন তিনি। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি তাঁর দিনপঞ্জী বা ডায়রীতে উল্লেখ করেছেন[১] -“ | আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। | ” |
ব্যক্তিগত জীবন
তিনি হিরন্ময়ী দেবী নাম্নী এক বিদূষী নারীকে ১৮৮৩ সালে (৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) বিবাহ করেন। হিরন্ময়ী দেবী রজনী'র লেখা কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ও সমালোচনা ব্যক্ত করতেন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র - শচীন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র, ভুপেন্দ্র ও ক্ষীতেন্দ্র এবং দুই কন্যা - শতদলবাসিনী ও শান্তিবালা ছিল। কিন্তু ভুপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন -“ |
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ, তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷ তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি, তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷ |
” |
সাহিত্য-সংস্কৃতি
রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাই তাঁর ভবিষ্যত জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। ভাঙ্গাকুঠি'র তারকেশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁর সঙ্গীত সাধনাও রজনীকে সঙ্গীতের প্রতি দূর্বার আকর্ষণ গড়তে সাহায্য করে।শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বাবলীল ভঙ্গীমায় বাংলা ও সংস্কৃত - উভয় ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলোকে গান আকারে রূপ দিতে শুরু করেন। পরবর্তীতে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান পরিবেশন করতেন। রজনী'র কবিতাগুলো স্থানীয় উৎস, আশালতা প্রমূখ সংবাদ-সাময়িকীতে অনেকবার প্রকাশিত হয়েছিল। কলেজ জীবনের দিনগুলোতে তিনি গান লিখতেন। অভিষেক অনুষ্ঠান ও সমাপণী বা বিদায় অনুষ্ঠানেই গানগুলো রচনা করে গাওয়া হতো। তিনি তার অতি জনপ্রিয় গানগুলো খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচনা করতে সক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। তেমনি একটি গান রাজশাহী গ্রন্থাগারের সমাবেশে মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে রচনা করেছিলেন[১] -
“ | তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরনী সরসা; ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা৷ |
” |
“ | কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল। | ” |
—একান্ত অনুগত
শ্রীরজনী কান্ত সেন |
বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন
স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর গান ছিল অসীম প্রেরণার উৎসস্থল। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউনহলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিলাতী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ। ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষতঃ আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরী বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরী কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। এর ফলে কিছুসংখ্যক ভারতবাসী খুশী হতে পারেননি। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়দেরকে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গান -“ | মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই; দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷ |
” |
এ গানটি রচনার ফলে পুরো বাংলায় অদ্ভূত গণ-আন্দোলন ও নবজাগরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গানের কথা, সুর ও মাহাত্ম্য বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করায় রজনীকান্তও ভীষণ খুশী হয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গও গানটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপণায় অগ্রসর হতে থাকেন। ভারতীয় বিপ্লবী নেতারাও পরবর্তী বছরগুলোয় বেশ সোৎসাহে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গানটিকে ঘিরে।
পরবর্তীকালে তিনি প্রায় একই ঘরানার আরো একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেন -
“ | আমরা নেহাত গরীব, আমরা নেহাত ছোট,- তবু আছি সাতকোটি ভাই,-জেগে ওঠ! |
” |
“ | তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে; তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে৷ |
” |
সঙ্গীত জীবন
রজনীকান্ত শৈশবকাল থেকে সঙ্গীতপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কোথাও কোন সুমধুর সঙ্গী শুনলেই তিনি সুর, তাল-সহ তৎক্ষণাৎ তা কণ্ঠস্থ করতে পারতেন। তাঁর পিতা গুরুপ্রসাদ সেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ফলে পিতার সাহচর্য্যেই শৈশবে সঙ্গীত অনুশীলন করার সুযোগ ঘটে তাঁর। বস্তুতঃ কাব্যের চেয়ে গানের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব অধিক। যৌবনে সঙ্গীত রচনায় বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় প্রদান করেন রজনীকান্ত।[৬]অক্ষয়কুমারের বাসভবনে আয়োজিত গানের আসরে তিনি স্বরচিত গানের সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। রাজশাহীতে অবস্থানকালে রজনীকান্ত সেন তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলালের কণ্ঠে হাসির গান শুনে হাসির গান রচনা শুরু করেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গান রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তিনি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখনীর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তাঁর মতো করে সমগোত্রীয় লেখা লিখতে শুরু করেন।
তাঁর রচিত গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে -
- দেশাত্মবোধক গান
- ভক্তিমূলক গান
- প্রীতিমূলক গান
- হাস্যরসের গান।
বাংলাদেশ এবং ভারতের অনেক সঙ্গীত শিল্পী কান্তগীতি গানগুলো গেয়েছেন। তন্মধ্যে - কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, নীলা মজুমদার, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য, অনুপ ঘোষাল, নিশীথ সাধু, হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য্য, অর্ঘ্য সেন, জুঁথিকা রায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতী মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, ইফফাত আরা দেওয়ান, উৎপলা সেন প্রমুখ অন্যতম।
কবিতা
মূল নিবন্ধ: কবিতা
কবি হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন রজনীকান্ত সেন। নির্মল আবেগ
ও কোমল সুরের ব্যঞ্জনায় তাঁর গান ও কবিতাগুলো হয়েছে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ।ব্যঙ্গ কবিতা
রজনীকান্ত সেন ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্তের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বুড়ো বাঙ্গাল কবিতাটি তেমন-ই একটি।[৭] কবিতাটি রস-নিবেদনে এবং ব্যঙ্গ চাতুর্যতায় - এক কথায় অপূর্বঃ-“ | বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা, ঢাইল্যা দিচি পায়; তোমার লগে কেমতে পারুম, হৈয়্যা উঠছে দায়। আরসি দিচি, কাহই দিচি, গাও মাজনের হাপান দিচি, চুলে বান্দনের ফিত্যা দিচি, আর কি দ্যাওন যায়? |
” |
“ | রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি, টোডরমল্লের কটা ছিল নাতি, কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি, এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির। আকবর শাহ কাছা দিত কিনা, নূরজাহানের কটা ছিল বীণা, মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা, এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির। |
” |
নীতি কবিতা
গল্প, কাহিনী বা নিছক কলাশিল্পের সাহায্যে কবি জ্ঞানগর্ভ নীতিকথা বা তত্ত্ব প্রচার করেন। নীতিকথার তীব্রতা কল্পনার স্পর্শে যাতে কোমল ও কান্তরূপ পরিগ্রহ করে, তাই কবি হৃদয়ের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সেই দৃষ্টিকোণে রজনীকান্ত সেনের অমৃত কাব্যগ্রন্থটি একটি স্বার্থক নীতি কবিতার অন্তর্ভূক্ত।[৯] উপযুক্ত কাল কবিতায় তিনি লিখেছেন -“ | শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে, জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে। চৈত্রমাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে, কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে? |
” |
কর্মজীবন
বি.এল ডিগ্রী অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৮৯১ সালে তিনি রাজশাহীতে আইন পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। তাঁর জ্যেঠা অর্থাৎ বাবার বড় ভাই তখন রাজশাহীতে উকিল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ফলে আইন পেশায় রজনী'র দ্রুত উত্তরণ ঘটতে থাকে। কিন্তু আইন পেশার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই বেশী সম্পৃক্ত রাখতেন নিজেকে। ফলশ্রুতিতে তিনি তাঁর সুনাম হারাতে থাকেন। মক্কেলদের কাছে চাহিদামাফিক সময় দিতে পারতেন না। পরবর্তীকালে কিছুদিন তিনি নাটোর এবং নওগাঁ জেলায়ও অস্থায়ীভাবে মুন্সেফ হিসেবে কাজ করেছিলেন রজনীকান্ত সেন।অন্যান্য
রজনী শারীরিক কসরৎ এবং খেলাধূলায় বেশ আগ্রহী ছিলেন। খেলাধূলায় অতি উৎসাহের কারণে নিজ ব্যয়ে ভাঙ্গাবাড়ীতে ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করতেন। নিজ গ্রামে তিনি বেশ সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ছিলেন। সর্ববিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন - বিশেষ করে গান-বাজনা, খেলাধূলা, অভিনয়-কলা প্রভৃতি বিষয়ে পারঙ্গমতাই এর মূল কারণ। গ্রামের নিরক্ষর মহিলাদের মাঝে শিক্ষা প্রসারের জন্যেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রজনীকান্ত সেন। এরফলে পশ্চাদমুখী, অশিক্ষিত গ্রামবাসীর অনুন্নত চিন্তা-ভাবনার মুখোমুখি হন তিনি। এমনকি তাঁর ছাত্রদের কাছ থেকেও বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তা মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে।রচনাসমগ্র
রাজশাহী থেকে প্রচারিত উৎসাহ মাসিক পত্রিকায় রজনীকান্তের রচনা প্রকাশিত হতো। তাঁর কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু মূখ্যতঃ দেশপ্রীতি ও ভক্তিমূলক। হাস্যরস-প্রধান গানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। জীবিত থাকাকালে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সেগুলো হলো -- বাণী (১৯০২)
- কল্যাণী (১৯০৫)
- অমৃত (১৯১০)
- অভয়া (১৯১০)
- আনন্দময়ী (১৯১০)
- বিশ্রাম (১৯১০)
- সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩)
- শেষদান (১৯১৬)
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য-কর্ম এবং অবিস্মরণীয় আধ্যাত্মিক গানগুলো রচনার মাধ্যমে রজনীকান্ত সেন অমরত্ব লাভ করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। প্রধানতঃ তাঁর গানগুলো হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরণার। এতে তিনি কীর্তন, বাউল এবং টপ্পার যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষমতা দেখিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অগণিত শ্রোতা-লেখকের মন জয় করেছেন।
শেষ দিনগুলোয়
১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর প্রদাহজনিত কারণে সমস্যা ভোগ করতে থাকেন। আর্থিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করা সত্ত্বেও একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁকে জোরপূর্বক কলকাতায় প্রেরণ করেন পরিবারের সদস্যরা। একজন ব্রিটিশ ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ও তাঁর ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার হয়েছে বলে সনাক্ত করেন। অতঃপর তিনি কলকাতার বিভিন্ন প্রথিতযশা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁর অবস্থার আর উত্তরণ হয়নি, বরঞ্চ উত্তরোত্তর অবনতি হতে থাকে।শেষ আশ্রয় হিসেবে বারাণসীতে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রকৃতি প্রদত্ত আরোগ্য লাভের আশায় বেশ কয়েকমাস ব্যয় করেন। এ ব্যয়ভার বহনের লক্ষ্যে খুবই বিষাদ চিত্তে তাঁর প্রকাশিত বাণী এবং কল্যাণী বই দু'টোর গ্রন্থস্বত্ত্ব বিক্রী করে দিতে বাধ্য হন তিনি। কলকাতায় পুণরায় ফিরে আসলেও শারীরিক অবস্থা ক্রমশঃ আরো ভেঙ্গে পড়ে। অতঃপর তিনি ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। এরফলে তিনি কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও চীরতরে তাঁর বাকশক্তি হারান। অপারেশন পরবর্তী জীবনের বাকী দিনগুলোয় হাসপাতালের কটেজ ওয়ার্ডে ব্যয় করেন।
হাসপাতালে থাকাকালীন তিনি তাঁর দৈনিক দিনলিপি বা ডায়রী সংরক্ষণ করতেন। এছাড়াও, আত্মজীবনী লিখতে শুরু করলেও একটিমাত্র অধ্যায়েই তা শেষ হয়ে যায় মৃত্যুজনিত কারণে। কিছু কবিতাপ্রেমী ব্যক্তিত্ব এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা তাঁর দেখাশোনা ও খোঁজ-খবর নিতেন। মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী এবং শরৎ কুমার রায় তাঁকে আর্থিক দিক দিয়ে যথাসাধ্য সহযোগিতা করেন। স্মর্তব্য যে, ১১ জুন, ১৯১০ তারিখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনীকান্ত সেনকে দেখার জন্যে হাসপাতাল পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন। তখন রজনী'র লিখিত একটি গান তাঁর পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ এবং কন্যা শান্তিবালা হারমোনিয়াম সহযোগে গাচ্ছিলেন। রজনী বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাঁকে ব্যথা-বেদনা দিয়ে তার পবিত্র আত্মাকে শুদ্ধ করছেন। এ বিশ্বাসটুকু তার অন্তঃশক্তি প্রদান করে শারীরিকভাবে ব্যথা থেকে সাময়িক বিমুক্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাঁকে আত্মনিমগ্ন রেখে এ গান রচনা করতে সাহায্য করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে ঐদিন সাক্ষাতের প্রতিফলন হিসেবে নিম্নবর্ণিত গানটি রচনা করেছেন রজনীকান্ত সেন।
“ | আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চূর, তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর৷ ঐ গুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে, তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর; |
” |
মহাপ্রস্থান
রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল অসম্ভব ব্যথায় পরিপূর্ণ। তিনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে (১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮শে ভাদ্র) মঙ্গলবার রাত্রি সাড়ে আট ঘটিকার সময় লোকান্তরিত হন।[১][৫]স্বীকৃতি
ক্ষণজন্মা এই অমর সঙ্গীতকার ও লেখক ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী ১৯৮৯ সালে রজনীকান্ত সেন শিরোনামে একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন।তথ্যসূত্র
- Masik Basumati, 1963 Kartik Edition, p20
No comments:
Post a Comment